মনোনেশ দাস : ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা মুক্তাগাছায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার রেফাজ উদ্দিন (৮৪)আজ শুক্রবার বেলা ১টা ৩০ মিনিটে মুক্তাগাছা হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। তিনি স্ত্রী, ৪ পুত্র, ২ কন্যা রেখে যান।পারিবারিক সূত্রে জানায় , আগামীকাল শনিবার সকাল ১০টায় গ্রামের বাড়ি মুক্তাগাছা বনবাংলায় সকাল ১০টায় জানাজা শেষে মুক্তাগাছা পৌরসভা লক্ষীখোলা গোরস্থানে তাকে সকাল ১১টায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে ।। ।জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি কমান্ডার মুক্তাগাছা রফিজ উদ্দিনের (রেফাজ কমান্ডার) খোঁজ কেউ রাখতেন না। একাত্তরে দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে সম্মুখ সমরে নেতৃত্বদানকারী এ মুক্তিযোদ্ধা পচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেফতার ও নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। আজীবন সংগ্রামী এ কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা জীবন সায়াহৃে এসে নানা রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন । দেহে স্বাধীনতা বিরোধীচক্রের নির্যাতনের ক্ষত আর জটিল রোগ নিয়ে অর্থাভাবে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় অজপাড়াগাঁয়ে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনেন তিনি । একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারা দিয়ে হানাদারের কবলে আক্রান্ত দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে নিজ এলাকা মুক্তাগাছার যুবকদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য রফিজ উদ্দিন রেফাজ। ২৩ এপ্রিল মুক্তাগাছা পাকবাহিনীর দখলে চলেগেলে তরুণদের সঙ্গে নিয়ে তিনি ভারতের ঢালুতে চলে যান। সেখানে কোম্পানি গঠন করে দেশে এসে শত্রুর বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ জয় করতে থাকেন। তার সাথে যুদ্ধে অংশ নেন তার এক সহোদরও। ভালুকার আফসার কোম্পানির মতো মুক্তাগাছার রেফাজ কোম্পানির যুদ্ধের কিংদন্তি বৃহত্তর ময়মনসিংহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তার কোম্পানির বীরত্বগাথায় আকৃষ্ট হয়ে ভারতীয় অফিসার বালজিত সিং বাবাজিসহ একাধিক অফিসার তার সাথে স্বাক্ষাৎ করে তার কাজের প্রশংসা করেন। বিবিসি ও রয়টার্সের প্রক্ষাত সাংবাদিকরা তার স্বাক্ষাৎকার নিয়ে যুদ্ধের স্টোরি করেন। এ সময় পাকবাহিনী রফিজ উদ্দিন রেফাজকে জীবিত অথবা মৃত ধরে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে। যুদ্ধের সময় তার পরিবার দখলদার পাকিস্তান আর্মি ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনী দ্বারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। ১০ ডিসেম্বর বীর দর্পে মুক্তাগাছা মুক্ত করে এলাকায় আসেন। বঙ্গুবন্ধুর আহ্বানে অপর চারটি কোম্পানির যোদ্ধাসহ তার কোম্পানির যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহের সর্বোচ্চ সংখ্যক অস্ত্র জমা দেন। তখন ভারতীয় যৌথবাহিনী প্রধান জেনারেল অরোরা তাকে ডেকে নিয়ে আশির্বাদ করেন। স্বাধীনতার পর সকলের প্রত্যাশা ছিল রফিজ উদ্দিন রেফাজ এমনকি তার কোম্পানির একাধিক যোদ্ধা তাদের বীরত্বপূর্ণ আবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। উল্টো পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বপরিবারে নিহত হলে এর প্রতিবাদে মুখর হওয়ায় পরাজিত শত্রুদের রোষানলে পড়েন তিনি। অনেকের মতো তার ভাগ্যেও ঘোর অমানিশা নেমে আসে। বঙ্গবন্ধুর অন্ধভক্ত দেশ প্রেমিক এ বীর সেনানীকে বিনা অপরাধে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। হাতে পায়ে বাঁশের চেংগি দিয়ে অমানসিক নির্যাতন করা হয়। শুধু তাই নয় মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত রাজাকার, আলবদর, দালাল চক্র প্রতারণার মাধ্যমে তার পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবেও পঙ্গু করে দেয়। স্ত্রীর গহনাসহ, টাকা পয়সা সর্বস্ব হাতিয়ে নেয় সেই দালালরা। এক সময় মৃতপ্রায় অবস্থায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। সেই নির্যাতনের ক্ষত তিনি সারাজীবন ধরে বহন করে চলেছেন। তখন তার হাত পায়ের রগগুলো থেতলে দেয়া হয়। একসময়ের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হয়েও পচাত্তরের পর সন্তানদের পড়ালেখার ব্যয় বহনেও অক্ষম হয়ে পড়েন তিনি । এখন তিনি গ্রামের বাড়িতে বিছানায় শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যুর প্রহর গুনেন। মুক্তিযুদ্ধে শত্রুর আঘাতে আহত হলেও শত চেষ্টায়ও তিনি যুদ্ধাহত ভাতাটি পর্যন্ত পাননি। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক যুদ্ধকালীন এমপিএ খোন্দকার আ. মালেক শহিদুল্লাহ বলেন, তার মতো এমন একজন যোদ্ধাকে কেন রাষ্ট্রীয় খেতাব দেয়া হয়নি তা আজও বুঝতে পারিনি।
EmoticonEmoticon